অরুন্ধতী
একটি অসমাপ্ত প্রেম কাহিনী
অরুন্ধতীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় বাবা বৈদ্যনাথ ধাম মন্দিরে (দেওঘর) । প্রথমে দেখে মনে হয়নি যে মেয়েটা বাঙালী । অবাঙালীদের মত কনুই অব্দি মেহেন্দি, চুড়িদার টাও পড়েছে কিরকম বিহারী ধাঁচায়, আবার ওড়না টাও কেমন করে যেন নিয়েছে । সাধারণত বঙ্গ ললনাদের ওমনি ভাবে ওড়না নিতে দেখি না । পুজো দেবার সময় দেখলাম হাতে আবার ট্যাটু করেছে । উফ !!! এই একটা জিনিস আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর ।
আসলে পাপ ধোবার জন্য তো আর আসিনি পুজো দিতে, অর্পিতার সাথে সম্পর্কের অবসানের পর মনমেজাজ টা একেবারেই ভাল নেই । হু হু করা বুকের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা আর একাকীত্বের চরম দংশনের তাড়িয়ে বেড়ানো থেকে নিজেকে রেহাই দিতে এই পরিবর্তন আর কি । ব্রেক-আপের পিছনে কি কারণ ছিল সেটা আজও বুঝিনি । সম্পর্কটা বোঝা লাগছিল না অন্য কাউকে পছন্দ হয়েছিল ? দেখেছো !! আবার ওসব নিয়ে ভাবতে বসলাম, থাক বাদ-দি, যা হয়েছে তা নিয়ে অতো না ভেবে এগিয়ে যাওয়াই ভাল ।
গণ্ড মূর্খের মত কাজ করেছি, শীত থাকবে ভেবে বেশ কিছু শীতের পোশাক ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি । যাই হোক, দেখে-টেখে নিয়ে ফেরার জন্য অটোতে বসে আছি আর অটো ভর্তি হবার অপেক্ষা করছি । হঠাৎ দেখি পাশে এসে বসল । মনে মনে ভাবলাম কোথায় নামবে কি জানি ? কিছুক্ষণ পর আড়চোখে দেখলাম তাড়াহুড়ো ভাবে মোবাইলে কিছু একটা করছে । আর একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে নজরে এলো Whatspp-এ বাংলা কিছু লেখা পড়ছে । এমন সময়ে ওর মোবাইলে একটা call এলো , "হ্যালো", বলার পরেই মুখটা ব্যাজার করে কলটা কেটে দিয়ে বলল "ধুর" । "ধুর" !! তার মানে বাঙালী । বুঝলাম incoming call টা দেখে বুঝতে পারেনি যে customer care থেকে কল করেছিল, incoming chargeটা গেল মনে হয় তাই বিরক্তি ভাব ফুটে আসল মুখে ।
আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম, মনটা এখনও অর্পিতার জন্য কেমন কেমন করছে । হয়তো সত্যি ভালোবাসা একেই বলে ; চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটার প্রতি যে অনুভূতি থেকে যায় সেটা হয়তো চাইলেও অন্য কারোর প্রতি আসে না । ওই অনুভূতিটা শুধু এক জনের জন্যই । উফ !! দেখেছো আবার কিসব ভুল-ভাল ভাবতে লাগলাম । পাশে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে আছে অথচ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এসব ভাবছি । এই ভেবে ওর দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি . . . যাহ্, মেয়েটা কই ? কখন যে নেমে পড়েছে সেটা খেয়াল করিনি । বেশ একটা মোহময়ী টাইপ পারফিউম ব্যবহার করে মেয়েটা । হাল্কা-স্নিগ্ধ গন্ধ টা নাকে এলে ভাল লেগে যায় আপনা থেকেই ।
আজ ফেরার পালা, ফিরে যাব নিজের বাসায় । ট্রেনে জানালার ধারে একটা সিট দখল করে বসে আছি । হঠাৎ দেখি অরুন্ধতী ২-৩ টে ব্যাগ নিয়ে আমার সামনে এসে একটু সড়ে বসতে বলল । কাকতালীয় ব্যাপারটায় একটু হতবাকই হলাম । সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে আপনা হতেই বেড়িয়ে গেল, "হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন"। ওর সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্র মহিলা ছিলেন । জিজ্ঞাসা করলেন, "কোথায় যাবে বাবা" ? আমি বললাম "বর্ধমান" । শুনে বেশ খুশি হয়ে বললেন, "বেশ ভালই হল, একটা সঙ্গী পাওয়া গেল"। আজ কিন্তু বাঙালী সাজে বেশ ভালই লাগছিল ওকে ; নীল চুড়িদার, সঙ্গে মানানসই ঝুমকো কানের দুল, চোখে কাজলের ছোঁয়া, ছোট্ট কালো টিপ আর ঠোঁটে হাল্কা লাল লিপস্টিক । গায়ের রং ফরসা, চোখ গুলো বেশ বড় বড়ই । ভ্রু-গুলো সযত্নে প্লাগ করা, চুলেতে হাল্কা লালের আভা আছে । এই প্রথম ওকে ভাল করে দেখলাম, ওর সৌন্দর্যতা টাকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম । আহা !! অপরূপা অরুন্ধতী . . . মুগ্ধ হয়ে গেলাম সৌন্দর্যে । Attitude নিয়ে চললেও দেখে মনে হল ছটফটে, এনারজেটিক সাথে মিষ্টতার ভাবটাও আছে । হাসি, সেটাও যেন মন ছুঁয়ে যায় ।
ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যস্থলের দিকে, আমরা যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত । অরুন্ধতী চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে, ভদ্রমহিলা উল-কাটা দিয়ে সোয়েটার বানাচ্ছেন আর আমিও যথারীতি আকাশপাতাল ভাবছি অন্যমনস্ক হয়ে । দিনের পড়ন্ত বেলার সূর্যাস্তের লাল আভা হঠাৎই ওর কানের দুলে ছিটকে এসে আমার চোখে পড়ছে । একটু বিরক্ত লাগলেও কিছু বলতে পারলাম না, ঘুমোচ্ছে যে । কিছুক্ষণ পর সেটা ভালই লাগছিল । ভাল করে খেয়াল করলাম, খুব ছোট্ট ছোট্ট সাদা পুঁতি ও নীল পাথর আর সোনালী জরি জাতিয় কিছু জিনিস দিয়ে বানানো অসাধারণ কানের দুলটা । সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে একটা কবিতা বানিয়ে ফেললাম । মাথায় আসাতে আপনা হতেই হাসলাম, অভ্যাসটা এখনও যায়নি তাহলে ।
এতক্ষণ পর্যন্ত নামটাও জানি না ওর । কিছুক্ষণ পর ভদ্র মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, "অরুন্ধতী, জামাইবাবুকে আমাদের স্টেশনে নিতে আসতে বলে দিয়েছিস তো" ? "হ্যাঁ, বাবাকে বলে দিয়েছি" । কানে এলো নামটা, বাহঃ !! নামটাও বেশ সুন্দর । ঊষার অরুন্ধতীর বিকিরিত আলোর মত এই অরুন্ধতীও যেন কানের দুল দিয়ে আলোর ছটা আমার চোখে ফেলছে । ভদ্র মহিলার হাতে বোনা সোয়েটারের প্রশংসা দিয়ে অল্পস্বল্প আলাপ পরিচয় শুরু করলাম । যদিও বেশী আলাপ জমানো গেলো না কারণ খানা জংশন পেরিয়ে এলাম । এবার নামতে হবে । সীট ছেড়ে উঠে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি । বর্ধমান ঢুকছে ট্রেন, হালকা হাওয়া লাগছে গায়ে । একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, কিছুটা দুষ্টু টাইপের । বর্ধমান স্টেশনে নেমে ওদের টাটা করে ঠিক ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে অরুন্ধতীকে কবিতাটি বললাম, "সূর্যাস্তের মলিন আলোয় রাঙায়িত ওই বিন্যস্ত চুল , অরুন্ধতীর সাজে সেজে উঠেছে জোড়া ঝুমকো কানের দুল" । অকস্মাৎ এমন শুনে অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ট্রেন যে তখন ছেড়ে দিয়েছে !!
লেখা - রোহিত রায়
(Copyright Protected)
1 comment:
Darun... Khub sundor..��
Post a Comment